সাক্ষাৎকার

‘পৃথিবীতে প্রায় ৭ হাজার ধর্ম রয়েছে’ – শ্রীমৎ কান্তিবন্ধু ব্রহ্মচারী মহারাজ

  কে, এম, বেলাল হোসেন স্বপন ১৩ ডিসেম্বর ২০২২ , ১:৩০:৩৮

সম্প্রতি হরিবাসর উপলক্ষে সনাতন ধর্মালম্বীদের গুরুদেব বাংলাদেশ মহানাম সম্প্রদায়-এর সভাপতি শ্রীমৎ কান্তিবন্ধু ব্রহ্মচারী মহারাজ পাবনার চাটমোহরে এসেছিলেন। ‘সাপ্তাহিক সময় অসময়’ পত্রিকার প্রকাশক ও সম্পাদক কে. এম. বেলাল হোসেন স্বপন তাঁর একটি সাক্ষাৎকার রেকর্ড করেন। শ্রীমৎ কান্তিবন্ধু ব্রহ্মচারী মহারাজ-এর দেয়া সাক্ষাৎকারটি প্রকাশ করা হলো

সময় অসময় : আপনার জন্মস্থান কোথায়? আপনি ধর্মীয় উপাসক হওয়ার বিষয়ে কারও অনুপ্রেরণা ছিল কি?
শ্রীমৎ কান্তিবন্ধু ব্রহ্মচারী মহারাজ : আমার জন্ম বরিশাল জেলায় (বর্তমানে ঝালকাঠি জেলা)। বর্তমান বয়স প্রায় ৮০ বছর। ছোটবেলা থেকেই ধর্মীয় বিষয়ে প্র্যাক্টিস করতাম, আমার মা-বাবা আমাকে ধর্মীয় শিক্ষায় উৎসাহ দিতেন। তারা শিখিয়ে ছিলেন যে, সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে ভগবানের উদ্দেশ্যে প্রণাম করবে। গাভী বা পশু-পাখিকে কখনও আঘাত করবে না। তাদের সাধ্যমত খাবার দেবে, কখনোই প্রহার করবে না। পরবর্তীতে শ্রীমৎ মহানামব্রত ব্রহ্মধচারী মহারাজের সংস্পর্শে এসে আমার ধর্মীয় জ্ঞানার্জনের স্পৃহা আরও বেড়ে যায়। আমার গুরুদেব শ্রীমৎ মহানামব্রত ব্রহ্মচারী মহারাজ যিনি আমার জন্মের আগে লন্ডন ও আমেরিকায় পড়াশুনা করে ডবল এমএ পাশ করে ছিলেন। আমি চিন্তা করলাম হিউম্যান বডি-টা এক সময় পঁচে যাবে। বরং যদি মানুষের কাজে লাগে, তাহলে সেটা দীর্ঘস্থায়ী হবে। পৃথিবীতে যাঁরা বড় হয়েছেন, তারাও দেহটা রেখে যাননি কিন্তু তাঁরা তাদের কাজ গুলো রেখে গেছেন।
আমি যখন ক্লাস নাইনে পড়ি, তখন থেকেই আমার ধর্মীয় শিক্ষা গ্রহণ শুরু। আমার প্রাইভেট টিউটর প্রিয়নাথ ব্যাপারি। তিনি আমাকে বলতেন- ‘দেখো, মানুষতো সকলেই জন্মে কিন্তু সকলেই মানুষের মাঝে পরিচিত হতে পারে না। আমি চাই আমার একজন ছাত্র যেন মানুষের মাঝে পরিচিতি লাভ করে।’ তিনি আমাকে এ ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করতেন। এখনও আমাকে বিভিন্ন বিষয়ে পড়াশুনা করতে হয়। দোলনা থেকে মৃত্যু পর্যন্ত শিক্ষার কোনো পরিসীমা নেই।

সময় অসময় : বর্তমানে আপনাদের আশ্রম কোথায় কোথায় রয়েছে? গুরুদেব হিসেবে আপনার বর্তমান অনুভূতি কেমন?
শ্রীমৎ কান্তিবন্ধু ব্রহ্মচারী মহারাজ : আমাদের মূল আশ্রম ফরিদপুরে হলেও ঢাকা, ময়মনসিংহ, সিলেট, চট্রগ্রাম, রংপুর সহ দেশের বিভিন্নস্থানে শাখা রয়েছে। গুরুদেব হতে পেরে আমার কাছে ভালো লাগছে কিন্তু অনেক সময় চিন্তা হয়, এই যে আমি এতগুলো মানুষের দায়িত্ব নিলাম, যদি সঠিকভাবে সে দায়িত্ব পালন না করতে পারি, সে ক্ষেত্রে দায়ী হবো। নৌকা যদি ডুবে যায়, দায়িত্বশীলতা নষ্ট হবে।
আমার গুরুদেব-এর পদাঙ্ক অনুসরণ করেই আমরা ঈশ্বরের বাণী প্রচার করে চলেছি। বাংলাদেশে সকল জেলাতেই আমাদের ভক্ত ও শিষ্য রয়েছে। ভারত একটি বিশাল দেশ, প্রায় ২৫টি প্রদেশ সেখানে বহু ভাষার মানুষের বসবাস। আমরা সাধারণত: বাংলাভাষায় অথবা ইংরেজি ভাষায় কথা বলে থাকি, কিন্তু যেহেতু আমরা হিন্দি ভাষা খুব ভালো বলতে পারিনা। তাই ভারতে দু’চারটি প্রদেশে ভক্ত/শিষ্য থাকলেও সকল প্রদেশে নেই। আমি ইতোমধ্যে ভারত, নেপাল, লন্ডন, আমেরিকা, ইন্দোনেশিয়া, কানাডায় বিভিন্ন ধর্মীয় সম্মেলনে যোগদান করছি। এই মুহূর্তে দেশে প্রায় পঞ্চাশ হাজার এবং বর্হিবিশ্বে ভারত, নেপাল, ইন্দোনেশিয়া, ইটালি, ফ্রান্স, কানাডা, আমেরিকা মিলিয়ে আরও প্রায় কুড়ি-পঁচিশ হাজার শিষ্য আমার কাছে দীক্ষা গ্রহণ করেছে।

সময় অসময় : বিশ্বের উন্নতদেশ গুলোতে যেমন- আমেরিকা, লন্ডন, ফ্রান্স, ইটালি, কানাডার শিষ্যদের মধ্যে ধর্মীয় অনুভূতি কেমন দেখতে পান?
শ্রীমৎ কান্তিবন্ধু ব্রহ্মচারী মহারাজ : ধর্মের ব্যাপারে তাদের আগ্রহ রয়েছে। তবে উন্নতদেশ গুলোতে তাদের কাজের সময়টাকে ধর্মের চেয়েও বেশি মনে করে থাকে। আমাদের দেশে হিন্দু পরিবারের মেয়েদের মত তারা সকাল ও সন্ধ্যায় পূজা দিতে পারে না। বিদেশে তারা খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে কাজে বের হয়ে যায়, সন্ধ্যায় ফিরে এসে পূজা করতে পারে না। হিন্দু নারীরা অন্যদিন প্যান্ট-শার্ট পড়লেও সপ্তাহে প্রতি রবিবার তারা শাড়ি ও সিঁদুর পড়ে এবং সেদিন তারা পূজো করার সুযোগ পায়।

সময় অসময় : আপনার মতে ধর্ম আসলে কি?
শ্রীমৎ কান্তিবন্ধু ব্রহ্মচারী মহারাজ : ধর্ম আসলে মানবিক গুনাবলীকে উন্নত করা। বিশ্বাস ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে। পৃথিবীতে প্রায় ৭ হাজার ধর্ম রয়েছে। একেক ধর্মের বিধি-বিধান, বিশ্বাস-অবিশ্বাস ভিন্ন ধরণের হয়ে থাকে। মানুষ যে ধর্মেরই হই না কেন, মানসিক গুণাবলী যদি কারও মধ্যে না থাকে, তাহলে পুরোটাই অর্ন্ত:সার শূণ্য। সে ধর্ম মানুষের কোনো কাজে আসবে না।

সময় অসময় : মানুষ কেন ধর্ম পালন করবে?
শ্রীমৎ কান্তিবন্ধু ব্রহ্মচারী মহারাজ : ধর্ম মানুষকে সুবন্ধিত করে, মানুষের অর্গান গুলোকে সচল রাখে। চোখ, নাক, কান সবকিছুতেই শুধু চাহিদা। ধর্ম বলেছে না, এই চাহিদা গুলোকে তুমি নির্দ্দিষ্ট সীমাবদ্ধতার মধ্যে নিয়ে আসো। মুসলমান ধর্মেও যেমন- নামাজ পড়া, রোজা রাখা। ধর্ম সৃষ্টিকর্তার প্রতি বিশ্বাস ও আস্থা বৃদ্ধি মাধ্যমে অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে নিয়ন্ত্রণে রেখে মানুষকে সমাজের কল্যাণের পথে নিয়ে আসে। ধর্ম মানুষের বিবেককে জাগ্রত রাখে এবং মানবিক হতে উদ্বুদ্ধ করে।

সময় অসময় : আমরা স্বর্গ-নরক বলে থাকি, এ সম্পর্কে আপনার অভিমত কি?
শ্রীমৎ কান্তিবন্ধু ব্রহ্মচারী মহারাজ : মানুষকে নিয়ন্ত্রিত রাখার জন্য সাধারণত: স্বর্গ-নরকের কথা উল্লেখ করা হয়ে থাকে। মানুষ মন্দ কাজ করলে শাস্তি পাবে, অপরদিকে ভালো কাজ করলে পুরস্কৃত হবে। এটাকে মানুষকে ভালো কাজে উদ্বুদ্ধ করার একটি প্রক্রিয়া মাত্র। স্বর্গ-নরক সম্পর্কে কোনো প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ নাই, এটা শুধুমাত্র অনুভূতির বর্হি:প্রকাশ মাত্র।

সময় অসময় : বিভিন্ন ধর্মে গুরু’র শিষ্যত্ব গ্রহণের হেতু কি?
শ্রীমৎ কান্তিবন্ধু ব্রহ্মচারী মহারাজ : দু’টি জায়গায় গুরু লাগেনা। প্রথমত. হলো আপনি বাচ্চাদের চকলেট দিতে চাইবেন, দেখবেন তারা হাত পেতে নিবে। এখানে গুরুর কোনো উপদেশের প্রয়োজন হয়না। দ্বিতীয়ত. বয়:সন্ধিতে একজন নারী-পুরুষের দাম্পত্য জীবন পরিচালনা। এ বিষয়ে কোনো ট্রেনিং সেন্টার নাই, এ ক্ষেত্রে গুরুরও কোনো প্রয়োজন হয়না। এছাড়া জীবনের প্রতিক্ষেত্রে ট্রেনিং সেন্টার আছে, গুরুদেব হচ্ছেন একজন গাইড হিসেবে শিষ্যদের সঠিক পথ দেখান। একমাত্র গড, ভগবান, ঈশ্বর বা আল্লাহ্ ছাড়া পৃথিবীতে কেউ পরিপূর্ণ নয়।

সময় অসময় : আমরা জন্ম সূত্রে পারিবারিক ধর্মপালন করে থাকি। এ ব্যাপারে আপনার প্রতিক্রিয়া কি?
শ্রীমৎ কান্তিবন্ধু ব্রহ্মচারী মহারাজ : যদি আমার জন্ম চীন বা জাপানে হতো, তাহলে হয়তো আমার নাম রাখা হতো ‘লিয়াং ফিয়াং’। আবার যদি সৌদি আরব, আবুধারি, দুবাই, বাহরাইন আমার জন্ম হতো, তাহলে হয়তো আমার নাম হতো ‘সালাউদ্দিন’। আমার হিন্দু পরিবারে জন্ম বলেই ‘গীতা’ পড়ছি, কিন্তু মুসলিম পরিবারে জন্ম হলে নিশ্চয়ই আমাকে ‘কুরআন’ পড়তে হতো। এতে অসুবিধা কি? যিনি যে পরিবারেই জন্মগ্রহণ করুন না কেন, যদি তিনি সে ধর্ম সঠিকভাবে পালন করে চলেন। তাহলে নিশ্চয়ই বিশে^র সকল মানুষ সহ জীবের কল্যাণ হবে। আমেরিকায় গিয়ে নিরামিষ খাই, কিন্তু জাপান-কোরিয়া গেলে আমাকেও হয়তো কচ্ছপ, সাপ, ব্যাঙ খেতে হতো। অথচ আমার পছন্দের খাবার পেঁপে।

সময় অসময় : বিশ্বের সকল ধর্মের, সকল মানুষের উদ্দেশ্যে বিশেষ কোনো বাণী দিবেন কি?
শ্রীমৎ কান্তিবন্ধু ব্রহ্মচারী মহারাজ : আমি প্রতিদিন যখন প্রার্থণা করি, তখন সারাবিশ্বের সকলের মঙ্গল কামনা করে থাকি। মানুষ থেকে শুরু করে সকল প্রাণি এমনকি গাছ পর্যন্ত যেন দুঃখ-কষ্ট ভোগ না করে। কারণ, পৃথিবীতে বেঁচে থাকার জন্য গাছ অপরিহার্য। অক্সিজেন ছাড়াতো মানুষ বাঁচবে না। তাই আমরা সাধারণত: গাছকে সম্মান করি, জল দেই, পুজো করি। বেঁচে থাকার জন্য জল প্রয়োজন, তাই আমরা গঙ্গা-স্বরস্বতী এসকল নদীকে আমরা সম্মান করি। আমি গৌরবের জন্য বলছি না। প্রাপ্ত গুরুদক্ষিণা দিয়ে ৩০/৩৫ জন ছেলে-মেয়েকে আমি পড়ানোর দায়িত্ব নিয়েছি। তারা দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া করছে। যাদের অধিকাংশই খাগড়াছড়ি-বান্দরবান জেলার নিভৃত পল্লীর হতদরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছে। যাদের মা-বাবা কেউ একটি অক্ষরও চেনেনা। ইতিমধ্যে এধরণের অনেক ছেলে-মেয়ে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করে দেশের বিভিন্নস্থানে চাকরি করছে। এটাকে আমি বড় ধর্ম মনেকরি। ওরাতো চুরি করছে না, তথাকথিত শান্তি বাহিনীতে যুক্ত হচ্ছে না। ওরা শিক্ষিত হলে সমাজের ক্ষতি হবে না, রাষ্ট্রেরও কোনো ক্ষতি হবে না। বরং ওরা শান্তি বাহিনীতে যোগ দিলে নিজের জীবন বিপন্ন করতো এবং রাষ্ট্রের ক্ষতি করতো।

সময় অসময় : ‘সাপ্তাহিক সময় অসময়’ পত্রিকার পাঠকদের উদ্দেশ্যে সাক্ষাৎকার প্রদানের জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
শ্রীমৎ কান্তিবন্ধু ব্রহ্মচারী মহারাজ : আপনাকের ধন্যবাদ। আপনার মাধ্যমে পাঠক সমাজকেও ধন্যবাদ জানাই। ঈশ্বর বিশ্বের সকল জীবের মঙ্গল করুন।

(সাক্ষাৎকারটি সাপ্তাহিক সময় অসময় পত্রিকায় প্রকাশিত। সবুজ আলো’র পাঠকদের জন্য হুবহু প্রকাশ করা হলো)