মতামত

সংবাদপত্র – সাংবাদিকতা এবং আমি –

  আমিরুল ইসলাম রাঙা ১৭ ডিসেম্বর ২০২২ , ৮:৩০:৩৮

। আমিরুল ইসলাম রাঙা।

সংবাদপত্রের সাথে আমার সম্পর্ক ছোটবেলা থেকে। আমার বয়স যখন ৯/১০ বছর তখন থেকেই সংবাদপত্রের নিয়মিত পাঠক ছিলাম। আমার জন্মের ১৫/২০ বছর আগের প্রকাশিত পেপার পড়ার সুযোগ পেয়েছিলাম । শিশুকালে যখন পেপার পড়তাম তখন একটি সংবাদ স্থান-কাল-পরিবর্তন করে অবিকল সংবাদ বানিয়ে ফেলতাম। তখন থেকেই মনের মধ্যে সাংবাদিক হওয়ার আগ্রহ বাসা বাঁধে । পরবর্তীতে মাত্র ১৮ বছর বয়সে সংবাদপত্রের সম্পাদক হওয়া এবং ঐ বয়সে জাতীয় পত্রিকার জেলা সংবাদদাতা হওয়ার সুযোগ ঘটে। সুযোগ হয় আটঘরিয়া উপজেলায় প্রেসক্লাব গঠন করার। এমনকি তরুন বয়সেই মফঃস্বল সাংবাদিকদের সংগঠন জাতীয় সাংবাদিক সমিতি কেন্দ্রীয় কার্যকরী কমিটির সদস্য হওয়ার সুযোগ হয়েছিল। আজ সেই সব গল্প অল্প কথায় লিখতে চা

১৯৬০/৬১ সালের কথা। আমি তখন আটঘরিয়া থানার সড়াবাড়িয়া প্রাইমারী স্কুলের টু/ থ্রির ছাত্র। আমার পিতা ঐ স্কুলের প্রধান শিক্ষক। তখন ৮/১০ গ্রামের মধ্যে একটাই স্কুল। গোটা থানায় হাইস্কুল নাই। ফাইভের পর সিক্স পড়তে হলে, পাবনা শহরে অথবা ঈশ্বরদী থানার দাশুড়িয়া স্কুল ছাড়া পড়াশুনা করার সুযোগ ছিল না । গরীব ছাত্রদের ৮০/৯০ ভাগ ছাত্রের পড়াশুনা তখনই শেষ হয়ে যেতো । আমার পিতা আমি জন্মগ্রহনের আগে থেকে পেপার নিতেন। আমার ধারনা উনি থানার একমাত্র পেপার পড়ার পাঠক ও গ্রাহক ছিলেন। তখন পোস্ট অফিসের মাধ্যেমে পেপার আসতো। ৭/১০ দিনের পেপার একসাথে পেতেন। যখন পেপার পেতেন তখন সেগুলিই হতো নুতন পেপার। দেখা যেতাে সেই নুতন পেপারগুলি ১০/১৫ দিন আগের। পুনরায় পেপার না আসা পর্যন্ত আগের পেপারগুলো কাছেই থাকতো। নুতন পেপার পেলে আগেরগুলো তারিখ মিলিয়ে সযত্নে বান্ডিল করে রেখে দিতেন। একবছর শেষ হলে বছরের বান্ডিলের উপর সাল লিখে ঘরের সিলিং এর উপর রেখে দিতেন।। আব্বার পেপার সংরক্ষণ করা থেকে শুরু করে অনেক কাজে আমি সহকারী ছিলাম। আমার পেপার পড়া আব্বার কারনেই শুরু হয়েছিল । উনি রিডিং পড়ানোর সময় পেপার ধরিয়ে দিতেন। রিডিং পড়া আর বাংলা লেখায় বানান ভুল হলে আর রক্ষা ছিল না । তখন পড়াশুনার করুন হাল শুনলে এখনকার ছেলে-মেয়েদের বিশ্বাস করা খুব কঠিন হবে। অনেক ছেলে-মেয়েরা অভাবের কারনে স্কুলে যেতো না। অনেকের জামা,স্যান্ডেল, বই ছিল না । আমাদের সময়ে ৭/৮ বছরের ছেলেমেয়েরা ওয়ানে পড়তো। ফোর ফাইভে পড়েও বাংলা রিডিং পড়তে পারতো না। ইংরেজি সেতো আরো কঠিন। সেটা শিখতে আরো উপরে উঠতে হতো। তখন আব্বার কাছে পেপারের রিডিং পড়তে পড়তে পেপারের পাঠক হয়ে উঠি । এরপরতো নুতন বাদ দিয়ে পুরাতন পেপার দেখা শুরু হলো। অতীত দেখতে দেখতে জন্মের আগের পেপার দেখা শুরু হলো। এখনো মনে আছে বৃটিশ শাসনামলের পেপারগুলি দেখতাম। ইত্তেফাক, আজাদ, ইত্তেহাদ সহ আরো নানা নামে কলকাতা থেকে আসা পেপার পড়েছি। আমাদের বাড়ীতে এত পুরাতন পেপারের বান্ডিল ছিল যে, যেগুলো খোলা যেতো না। নিউজ পেপারের রং লাল আকার ধারন করে মচমচে রুটির মত হয়েছিল। ধরলেই ছিঁড়ে যেতো। যাইহোক অল্পদিনেই পেপার পড়তে পড়তে পেপার পড়ায় আসক্ত হয়ে পড়লাম।

১৯৬৪ সালের দিকে পাবনা শহরে চলে এলাম। আরো পাঁচ বছর আগে থেকে আমাদের বাসা নেওয়া। বড় দুই ভাইকে নিয়ে দাদা দাদী শহরে থাকতেন । এরপর আমি আর ছোটবোন এসে যোগ হলাম। আমরা তিন ভাই আর,এম,একাডেমীর ছাত্র আর ছোট বোন আদর্শ বালিকা বিদ্যালয়ের ছাত্রী। আমার শহরে এসেই চোখ কান বড় হতে থাকলো। পড়াশুনার থেকে বেড়ানো আর আড্ডা বেশী ভাল লাগতো। এক কদম দুই কদম করে ঘুরতে ঘুরতে শহরের এপাড়া ওপাড়া শেষ হলো। স্কুলে পড়তে পড়তে ঢাকা সহ দেশের অর্ধেক জেলা বেড়ানো শেষ হলো। যোগ হলো লেখালেখি, রাজনীতি আর পত্র পত্রিকা পড়ার তীব্র অভ্যাস। বিকালে এডওয়ার্ড কলেজ মাঠ, তারপর নুতন ব্রীজের ঢালে মুসলিম ইনস্টিটিউশনের লাইব্রেরী ( বতর্মান বর্নমালা কিন্ডারগার্টেন স্কুল)। সেখানে সন্ধ্যা পর্যন্ত নানা রকম পেপার এবং পত্র পত্রিকা পড়তাম । এই অভ্যাস আস্তে আস্তে বাড়তে থাকলো। পাড়া ছেড়ে শহরে যাওয়া শুরু হলো । রাজনীতির অফিস থেকে অন্নদা গোবিন্দ পাবলিক লাইব্রেরী, সেখান থেকে সংবাদপত্র বিক্রির দোকান হয়ে উঠলো নিয়মিত আড্ডার জায়গা। আর এসবের কারনে পড়াশুনা থেকে আড্ডাবাজি বেড়ে গেল। বয়সের থেকে বুদ্ধি বেড়ে গেল। ছোট বড় বন্ধু বৃদ্ধি হলো। কবি সুকান্ত -কাজী নজরুলকে তখন আদর্শিক নেতা মনে করতাম। লেখাপড়া না করেই বিখ্যাত হতে চাইতাম। সালাম, রফিক, জব্বারের মত শহীদ হওয়ার স্বপ্নে বিভোর হয়ে থাকতাম । এরপর এলো ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ। নগন্য যোদ্ধা হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিলাম। নয়মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শেষ হলো। দেশ স্বাধীন হলো। পরের চিত্র পুরাটাই ভিন্ন হয়ে গেলো। দেশের নাম বদলানোর মত আমার জীবনটাও বদলে গেল।

মুক্তিযুদ্ধ শেষ হলো। জানুয়ারী মাসের শেষ দিকে মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র জমা দেওয়া হলো। যুদ্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনী আমাদের শহরের বাড়ী আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ছাই বানিয়ে দিয়েছিলো । শহরে আর থাকার জায়গা নাই। বড় ভাই ১৯৬৯ সালে সেনাবাহিনীর অফিসার পদে যোগ দেওয়ার পর স্বাধীনের পর পাকিস্তানে আটকা পড়ে । মেজ ভাই মুক্তিযুদ্ধ শেষে গ্রামের বাড়ীতে স্থায়ী হয়। তখন আমি একা পাবনা শহরে এলাম। রাজনৈতিক নেতা, সহযোদ্ধা বন্ধুদের আশ্রয়ে উঠলাম। আমার স্কুলের নিরঞ্জন স্যার মুক্তিযুদ্ধের সময় আমার গ্রামের বাড়ীতে উঠেছিলেন। আমি নিজে উনাকে নিয়ে ঈশ্বরদীর আরোমবাড়ীয়া দিয়ে সপরিবারে ভারতে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। স্বাধীনতার পর স্যার পাবনায় ফিরে এসে নক্সাল নেতা টিপু বিশ্বাসের খেয়াঘাট পাড়ার পরিত্যক্ত বাড়ীতে উঠেন। সাথে আমাকেও রাখলেন। আমি অনেকদিন স্যারের বাসায় ছিলাম । সারাদিন রফিকুল ইসলাম বকুল ভাইয়ের রিজার্ভ ক্যাম্প, ফজলুল হক মন্টু ভাইয়ের অফিস ( বানী সিনেমা হলের মালিক ইউনুছের বাড়ী) আর জেলা আওয়ামী লীগের অফিস ( সোনালী ব্যাংকের উত্তর পাশে লতিফ বিশ্বাসের বিল্ডিং) এই ছিল বিচরন ক্ষেত্র। ফেব্রুয়ারী মাসের প্রথম দিকে বকুল ভাই এবং মন্টু ভাই একটা পত্রিকার বের করার কথা বললেন। তাঁদের সিদ্ধান্তে সাপ্তাহিক ইছামতি নামে পত্রিকা বের করার সিদ্ধান্ত হলো। আমাকে সম্পাদক এবং পলিটেকনিকের জিএস আব্দুল হাই তপনকে প্রকাশক করা হলো। আওয়ামী লীগ অফিসের একটি রুম দেওয়া হলো। ফেব্রুয়ারী মাসের মাঝামাঝি পত্রিকা প্রকাশ শুরু হলো। স্বাধীনতার পর পাবনা থেকে প্রকাশিত প্রথম পত্রিকা। সাপ্তাহিক ইছামতি রূপকথা রোডের রূপালী প্রেস থেকে ছাপা হলো। এর পরপরই আহমেদ বশীর ভাই বের করলেন মেহনতি কন্ঠ এবং তারপর মির্জা সামসুল ইসলাম সাহেবের প্রবাহ পুনঃপ্রকাশ হলো।

১৮ বছর বয়সী আমি আর ১৯/২০ বছরের একদল যোদ্ধা হলাম কলম সৈনিক। পত্রিকার শুরুতেই কলম যুদ্ধ শুরু হলো। নেপথ্যে বকুল ভাই আর মন্টু ভাইয়ের শক্তি। তাঁদের নির্দেশ যেখানে অন্যায় সেখানেই তোমরা। অপরাধী সে যেই হোক তার বিরুদ্ধেই লেখতে হবে। আমরা ছোট মানুষেরা, ছোট কাগজে অল্প সময়ের মধ্যে যতটুকু করেছিলাম তা অনেক বড় মানুষের কাছে বহুদিন মনে থাকবে। জাতীয় পর্যায়ে তখন মাওলানা ভাসানীর হককথা’র মত পাবনায় ইছামতি হককথা বলা শুরু করলো। মনে পরে পাবনা শহরের “আমজাদ স্মরনিকার অন্তরালে “শিরোনামে একটি সংবাদ লিখে প্রভাবশালী এক নেতার রোষানলে পড়তে হয়েছিল। আরেকটি সংবাদ ছিল শাহজাদপুরের ছয় খুন নিয়ে লেখা একটি সংবাদ ” একটি ষড়যন্ত্র ছয়টি জীবন “। আরেকটি আলোচিত সংবাদ ছিল সুজানগরের। শিরোনাম ছিল ” রাজাকার এখন আওয়ামী লীগ নেতার জামাই। এমন সংবাদ প্রকাশে যেমন প্রশংসা অর্জন হলো তেমন নুতন নুতন শত্রু সৃষ্টি হতে থাকলো। তবে সাপ্তাহিক ইছামতি যতদিন প্রকাশ হয়েছে – ততদিন বীরের মতই মাথা উঁচু করে ছিল।

১৯৭২ সালে জুন জুলাই মাসে ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় সম্মেলনকে কেন্দ্র করে সারাদেশে সংগঠন বিভক্ত হয়ে পড়ে। এই বিভক্তিতে পাবনায় বিরূপ প্রভাব পড়ে। পাবনায় বকুল ভাই এবং মন্টু ভাই রব গ্রুপে অংশ নিলে আমরা তাঁদের পক্ষ নেই। পরবর্তীতে উনারা মুজিববাদী গ্রুপে ফিরে গেলে আমি সহ অনেকেই আর ফিরে যায়নি। ছাত্রলীগের এই বিভক্তির তিনমাসের ভিতর জাসদ গঠন হলো। আর আমাদের পরিনতি হলো ভয়াবহ। ইছামতি বন্ধ হয়ে গেলো। তখন আমি জাতীয় দৈনিক গণকন্ঠের পাবনার সংবাদদাতা হিসেবে সাংবাদিকতা শুরু করলাম। ৭৩ সালের ২১ মার্চ রক্ষীবাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হলাম। অমানুষিক নির্যাতনের পর জেলখানায় যেতে হলো। প্রায় তিন বছর জেলখানায় আটক ছিলাম। জেলজীবনে একদিনও পেপার পড়া বাদ যায়নি। যতদিন জেলে ছিলাম ততদিন পেপার নিতাম। জেলজীবনে প্রায় আট মাস দিনাজপুর জেলে ছিলাম। সেখানে থাকাকালীন স্থানীয় দৈনিক উত্তরায় ফিচার লেখতাম। নামে বেনামে ছাপা হতো। পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন, অধ্যাপক মহসীন আলী। উনি জানতেন না, আমি জেলখানায় আছি। এ বিষয়ে আমাকে এক জেলপুলিশ সহযোগিতা করতেন। যাইহোক এরপর অনামিকা নামে কলাম লিখতাম। এরপর ৭৫ সালের শেষের দিকে জেলখানা থেকে বের হলাম। দেশে তখন সামরিক শাসন।

১৯৭৭ সালের শেষ দিকে আবার সংবাদপত্রের সাথে জড়িয়ে পড়লাম। তখন ঢাকা থেকে প্রকাশিত ফেরদৌস আহমেদ কোরেশী সম্পাদিত দৈনিক দেশবাংলা এবং সিদ্দিকুর রহমান সম্পাদিত দৈনিক বাংলার মুখ পত্রিকায় কাজ শুরু করলাম। ঠিক এমন একটি সময়ে চিন্তা করলাম, আটঘরিয়াকে স্টেশন করে সাংবাদিকতা করলে কেমন হয়। বিশেষ করে আটঘরিয়া থানাকে পরিচিত করা ছিল মুল উদ্দেশ্য। তখন বা এখন একথা বলা যায় আটঘরিয়া হলো জেলার সবচাইতে অনুন্নত এলাকা। এমন এলাকাকে পরিচিত করার লক্ষ্য নিয়ে আটঘরিয়া থেকে বিভিন্ন পত্রিকাতে সংবাদ পাঠাতে লাগলাম। সেগুলি যথারীতি প্রকাশ হতে লাগলো। আমি নিজেই বেশ কিছু পত্রিকায় কাজ করতে লাগলাম। তখন পাবনা থেকে এক দুটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ হতো। আমার মনে পড়ে তখন পাবনা থেকে শফিউর রহমান সম্পাদিত সাপ্তাহিক পাবনা বার্তা এবং ইয়াছিন আলী মৃধা প্রকাশিত সাপ্তাহিক বিবৃতি বের হতো। এক সময় আমি নিজেও সাপ্তাহিক ইছামতি প্রকাশের আবেদন করি। যদিও আমি ডিক্লেয়ারেশন করাতে পারিনি। তখন পাবনায় স্বল্পসংখ্যক সাংবাদিক ছিলেন । এরমধ্যে অনেকেই ছিলেন খুব বড় মাপের সাংবাদিক। সিনিয়র সাংবাদিকরা ছিলেন দ্বিধাবিভক্ত। উভয় গ্রুপের সাথে আমার সৌহার্দ্যপুর্ন সম্পর্ক ছিল।

১৯৭৮ সালের ৭ মে আটঘরিয়া প্রেসক্লাব গঠন করা হলো। পাবনা এবং ঈশ্বরদীর পর জেলার তৃতীয় প্রেসক্লাব। ছয় সদস্য বিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হলো। কমিটির সভাপতি হলেন মোহাম্মদ এবাদত আলী, সাধারন সম্পাদক আব্দুস সাত্তার মিয়া। সদস্যরা হলেন, মোহাম্মদ ইয়াসিন, সিরাজুর দাহার মাতলু, মোঃ হাসান আলী এবং আমি । দেবোত্তর বাজারের একটি চায়ের দোকানে বসে এই কমিটি করা হয়েছিল। আটঘরিয়া প্রেসক্লাব গঠনকালে আমি ব্যতিত আর কারো সংবাদপত্রে কাজ করার ধারনা ছিলোনা। সেদিনের অনভিজ্ঞ সাংবাদিকরা খুব অল্পদিনেই সংবাদপত্র ও সাংবাদিক মহলে নিজেরা সুনাম এবং খ্যাতি অর্জন করতে সক্ষম হন। আটঘরিয়া প্রেসক্লাব গঠনের কিছুদিনের মধ্যেই এইচ,কে,এম আবু বকর সিদ্দিক, আব্দুল কুদ্দুস সাগর, মিয়া আব্দুস সাত্তার, মোঃ শহীদুল্লাহ,রুস্তম আলী, আব্দুল কুদ্দুস মাষ্টার, আবুল হোসেন, অধ্যাপক আব্দুল গফুর, মোঃ তৈয়াব আলী, আব্দুস সামাদ আজাদ,ফজলুর রহমান খান, এড. সানোয়ার হোসেন, এড. আতাউর রহমান চৌধুরী, প্রভাষক আমজাদ হোসেন, প্রভাষক মোবারক হোসেন, রইস উদ্দিন রবি, মোসলেম উদ্দিন,রবিউল ইসলাম রবি,রবিউল ইসলাম শাহীন সহ প্রমুখ সাংবাদিক আটঘরিয়া প্রেসক্লাবের সাথে যুক্ত হন। তাঁরা দীর্ঘদিন সুনামের সাথে কাজ করেছেন এবং এখনো করছেন । বর্তমান সময়ে খাইরুল ইসলাম বাসিদ, মোফাজ্জল হোসেন বাবু, মাসুদ রানা, নুরুল ইসলাম খান, প্রিন্স, আনারুল ইসলাম, মোঃ শফিউল্লাহ,শফিকুল ইসলাম মিঠু সহ অনেক সাংবাদিক আটঘরিয়া প্রেসক্লাবের সাথে জড়িত। আটঘরিয়া প্রেসক্লাব গঠনের পরের বছর আমাকে এক মেয়াদের জন্য সাধারন সম্পাদক বানানো হয়েছিল। হাতে গোনা কয়েকজন সাংবাদিকের মধ্যে দলাদলি শুরু হলে ৯০ সাল থেকে আমি নিষ্ক্রিয় হয়ে যাই । পরবর্তীতে আমাকে আটঘরিয়া প্রেসক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা ও আজীবন সদস্য এবং প্রতিষ্ঠাকালীন ছয়জন সদস্যকে আজীবন সদস্য করে সংগঠনে ফিরিয়ে নেওয়া হয়। ২০০০ সাল থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত আমাকে সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করার সুযোগ দেওয়া হয়।

আমার দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে কখনো কোন নির্বাচনে প্রার্থী হইনি। কেন যেন এবিষয়ে আমার আগ্রহ বরাবর কম ছিল। আমার কাছে কখনো নিজেকে যোগ্য প্রার্থী মনে হয়নি। তবে সাংবাদিকতা জীবনে দুইবার নির্বাচন করতে হয়েছিল। একবার জিতেছিলাম আর একবার পরাজিত হয়েছিলাম। জয়লাভের গল্পটা আগে বলি। ১৯৮২ সালে মফঃস্বল সাংবাদিকদের একমাত্র সংগঠন বাংলাদেশ সাংবাদিক সমিতির জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ঢাকা প্রেসক্লাব চত্বরে দুইদিনব্যাপী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সাংবাদিক সমিতির ইতিহাসে বড় সম্মেলন এবং কঠিন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। নির্বাচনে দুটি প্যানেল ছিল। একটি প্যানেল ছিল সভাপতি পদে ময়মনসিংহের ইনসাফ উদ্দিন আহমেদ এবং সাধারন সম্পাদক বরিশালের অধ্যাপক বদিউর রহমান। অপর প্যানেলে সভাপতি পদে মুন্সিগঞ্জের সফিউদ্দিন আহমেদ এবং সাধারন সম্পাদক গাইবান্ধার গোবিন্দ লাল দাস। তিনবছর মেয়াদী কমিটিতে প্রায় ৩৫ টি পদ ছিল। ইনসাফ-বদি প্যানেলে পাবনা থেকে অধ্যাপক শিবজিত নাগ সম্পাদকমন্ডলী এবং আমি কার্যকরী সদস্য পদে প্রার্থী হই। আমাদের বিপক্ষ প্যানেলে পাবনা থেকে সদস্য পদে দাঁড়িয়েছিলেন জনাব হাসনাতুজ্জামান হীরা। আমাদের প্যানেল ছিল ক্ষমতাসীন । বাংলাদেশের জেলা ও থানার ৯০ টি ইউনিটে প্রায় ১১ শত ভোটার ছিল। উভয় প্যানেলের মধ্যে আমি ছিলাম কনিষ্ঠ প্রার্থী। ব্যাপক প্রচার প্রচারনার মধ্য দিয়ে সম্মেলনের দ্বিতীয় দিন ঢাকা প্রেসক্লাবে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সেই নির্বাচনে আমাদের প্যানেলের ভরাডুবি হলেও যুগ্ম সাধারন সম্পাদক পদে সিরাজগঞ্জের আমিনুল ইসলাম চৌধুরী এবং আমি সহ ৩ টি সদস্য পদে জয়লাভ করি। ১৯৮২ থেকে ৮৫ সাল পর্যন্ত সেই কমিটি বহাল ছিল। নির্বাচনে পরাজয়ের গল্পটি ২০০৭ সালের। আটঘরিয়া প্রেসক্লাব নির্বাচনে সভাপতি পদে আমি পরাজিত হয়েছিলাম। সেখানে ভোটার ছিল ১৯ জন। সেই নির্বাচনে আমাকে হারিয়ে সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন জনাব এইচ,কে,এম,আবু বকর সিদ্দিক । আমি পেয়েছিলাম নয় ভোট এবং সিদ্দিক সাহেব পেয়েছিলেন দশ ভোট। এই নির্বাচনে আমি হেরে গেলে আমার বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছেন এমন ভোটারকে কাঁদতে দেখেছি। সেদিন আমাকে যারা পরাজিত করেছিলেন তাঁদের বিগত একযুগে কখনোই হারানোর চিন্তা করি নাই । এমনকি আর কখনো সেই হারানো পদ ফিরে পাওয়ার চেষ্টাও করি নাই।

আমি যখন সাংবাদিকতা শুরু করি তখন ছিল সাংবাদিকতা ও সংবাদপত্রের স্বর্নযুগ। যা কালের বিবর্তনে আজ বিলুপ্ত প্রায়। তখন সাংবাদিকতা করতে আসতো তাঁরাই যারা দেশ এবং মানুষকে নিয়ে ভাবতেন। আমাদের সময়ে প্রগতিশীল চিন্তার মানুষেরা সংবাদপত্রে বেশী কাজ করতেন। সমাজের মানুষ সাংবাদিক মহলকে সন্মান করতো। বর্তমান চিত্র পুরাটাই ভিন্ন। আগে অল্প সংখ্যক পত্রিকা ছিল সাংবাদিক ছিল হাতে গোনা। এখন সাংবাদিক হিসেবে কাজ করার অনেক সুযোগ। সাথে সুযোগ এবং সুবিধা সেটাও কম নয় । আগে মফঃস্বল শহরে সাংবাদিকতা করে টাকা পয়সা পাওয়াতো দুরের কথা নিজের টাকা খরচ করে সাংবাদিকতা করতে হয়েছে। দুই একটি পত্রিকা নামে মাত্র সন্মানী দিলেও অধিকাংশ পত্রিকা নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষা করতে যেয়ে সাংবাদিকদের দিয়ে বিজ্ঞাপন সংগ্রহ করাতো এমনকি পত্রিকা বিক্রি করার দায়িত্ব দিতেন। এখন সেগুলি করার দরকার হয় বলে মনে হয়না। আমাদের সময়কালে তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, আকরাম খাঁ, আহমেদুল কবীরদের মত চিত্তবানরা পত্রিকার মালিক ছিলেন। আর এখন সালমান এফ,রহমান, অঞ্জন চৌধুরী পিন্টু সাহেব যমুনা গ্রুপের বাবুল সাহেব, মোসাদ্দেক হোসেন ফালু সাহেব, এটিএন এর মাহফুজ রহমান সহ ধনী – বিত্তবানরা পত্র-পত্রিকা, টেলিভিশন সহ মিডিয়া জগতের মালিক এবং নিয়ন্ত্রক। এতে এক শ্রেনীর সাংবাদিকের লোকসান থেকে লাভ হয়েছে বেশী । লাভের কারনগুলো হলো, বিত্তবান ব্যবসায়ীরা মিডিয়া জগতে এসে সম্পাদক, সাংবাদিক এবং সংবাদপত্র বা মিডিয়ার লোকজনদের অভাব দুর করেছে। আমাদের চোখের সামনে যেসব নামকরা সাংবাদিক, সাহিত্যিক যেনারা অভাব অনটনের মধ্যে থাকতে দেখেছি, রিক্সা,বাসে চলতে দেখেছি তাদের এই ধনাঢ্য মিডিয়া মালিকরা চাহিদার অধিক সুবিধা দিয়ে নিয়োগ দিয়েছেন। সুবিধা শুধু উপরে নয় মফস্বলের সাংবাদিকদেরও দিয়েছেন। এখন জেলা শহরে সাংবাদিকতা করেও ভালভাবে সংসার চালানো যায়। এছাড়া বাড়তি সুযোগ সুবিধাতো আছেই। এখন ধনাঢ্য ব্যবসায়ী, প্রশাসনের একশ্রেনীর উৎসাহী দাতাদের দানে সাংবাদিকদের আড্ডাস্থল প্রেসক্লাব বা আবাসস্থল সেগুলির উন্নতিও নজিরবিহীন। গত দশক নয় শতক বর্ষেও এত উন্নতি হয় নাই।সংবাদ পত্রের সংখ্যা কত সঠিক উত্তর সংশ্লিষ্টজন বলতে পারবেন কিনা সন্দেহ। এরপর গত দুই দশকে টেলিভিশন চ্যানেল বেড়েছে গন্ডায় গন্ডায়। সাথে আছে অনলাইন পত্রিকা। যুগের পরিবর্তনে সাদাকালোর বদলে হয়েছে রঙিন। সংবাদপত্রের সাংবাদিকদের স্থান এখন সেকালের। এখন টেলিভিশনের সাংবাদিকদের কদর বেশী।

আমাদের সময়কালে সাংবাদিকদের কর্মকান্ড ছিল পুলিশের ডিআইবি’র মত। কোথাও কোন অনুষ্ঠান হলে নিজ তাগিদেই সংবাদের তথ্য নেওয়া হতো। দাওয়াত পাওয়ার দরকার হতো না। কোন অনুষ্ঠান হলে সাংবাদিক থাকতো দর্শক বা সুধীজনের পিছনে কিংবা পাশে। এখন অনেক সাংবাদিক আছেন যারা সামনের সারিতে বসতে চান। দ্বিতীয় সারিতে বসাটাও অপমান বোধ করেন। সংবাদপত্রে কাজ করার কোন নীতিমালা না থাকায় যেকোন ব্যক্তি পত্রিকার সম্পাদক বা সাংবাদিক হতে পারেন। এমনকি সাংবাদিক ব্যক্তিটি যুগ যুগ কোন সংবাদপত্রে কাজ না করলেও উনি সাংবাদিক থেকে যান । প্রেসক্লাবে কোন সাংবাদিক যদি সদস্য হতে পারেন, তাহলে আমৃত্যু তাঁর সদস্যপদ বহাল থাকে। প্রেসক্লাবে সদস্য হতে সাংবাদিক হতে হয় তবে সদস্য হওয়ার পর উনি যদি সাংবাদিকতা না করেন তারপরেও তাঁর সদস্য পদ বহাল থাকে। সাংবাদিকদের একমাত্র মিলনকেন্দ্র হলো প্রেসক্লাব। এক সময় প্রেসক্লাবের সুনাম, মর্যাদা বা সন্মান ছিল সবকিছুর উর্ধে। এখন ঠিক তার বিপরীত। এখন উপজেলা বা থানা থেকে শুরু করে জাতীয় প্রেসক্লাব পর্যন্ত সব জায়গায় দলাদলি। বহু জায়গায় একাধিক প্রেসক্লাব আছে। অনেক জায়গায় পাল্টাপাল্টি প্রেসক্লাব গঠন করে মুলতঃ নিজেরাই নিজেদের সুনাম ক্ষুন্ন করছেন। অনেক প্রেসক্লাবে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সাংবাদিকরা বিভক্ত। বিজয়ীদের সাথে পরাজিতদের বিরোধিতা অনেক ক্ষেত্রে স্থায়ী শত্রুতায় রুপ নেয়। অনেক জায়গায় প্রেসক্লাবের বিকল্পে নানা নামে সাংবাদিক সংগঠন গড়ে তোলা হয়েছে। অনেক স্থানে সাংবাদিক সংগঠনে দলাদলি থাকায় স্থানীয় প্রশাসন, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এমনকি জনগন পর্যন্ত বিব্রতবোধ করেন। প্রেসক্লাব, সাংবাদিক সমিতি, রিপোর্টার্স ইউনিটি, উত্তরাঞ্চল সাংবাদিক সংগঠন, গ্রামীন সাংবাদিক সংগঠন ইত্যাদি নামে এইসব সংগঠন নিয়ে জনগন বা প্রশাসন নয় প্রকৃত সাংবাদিকরাও বিব্রত। কাকে দাওয়াত দিবেন, কার সাথে কথা বলবেন বা মেলামেশা করবেন, সেটাতেও অপ্রীতিকর ঘটনার দৃষ্টান্ত আছে। পাঠক জানলে অবাক হবেন প্রেসক্লাব একটি স্বশাসিত প্রতিষ্ঠান। এদের নিয়ন্ত্রন করার কোন কর্তৃপক্ষ নাই। উপজেলাকে জেলা বা জেলাকে জাতীয় প্রেসক্লাব নিয়ন্ত্রন বা তদারকি করতে পারে না। যার যার মত সে সে চলে এবং চালায়। প্রেসক্লাব বা সাংবাদিকদের নিয়ন্ত্রন করার ক্ষমতা কোন সরকারী প্রতিষ্ঠানেরও নাই।

পরিশেষে সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতা নিয়ে আমার অল্প কথার গল্প আর এক কথায় শেষ করতে চাই। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৫ সালে বাকশাল গঠন করে চারটি পত্রিকা রেখে বাঁকী সব পত্রিকা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন হলে একটি জেলায় সাংবাদিক থাকতো চারজন। আর সেটা হলে আজ আমি এমন গল্প লেখার সুযোগ হয়তো পেতাম না।

(লেখক : আমিরুল ইসলাম রাঙা, প্রতিষ্ঠাতা ও আজীবন সদস্য, আটঘরিয়া প্রেসক্লাব, পাবনা।)