পাবনার চাটমোহরে বড়াল নদের তীরে বোঁথর গ্রামে শুরু হয়েছে হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী চড়ক পূজা ও মেলা। বৃহস্পতিবার (১৩ এপ্রিল) থেকে শুরু হওয়া তিন দিনব্যাপী এই পূজা ও মেলা শেষ হবে আগামী শনিবার (১৫ এপ্রিল)। হিন্দু সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে হাজার বছর ধরে চলে আসা এই চড়ক মেলা এখন ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সর্বজনীন উৎসবে পরিণত হয়েছে।
গত ৭ এপ্রিল পাট ঠাকুরের পাটে ধুপ দেয়া এবং ১২ এপ্রিল মন্দিরে মহাদেব এর অধিবাসের মধ্য দিয়ে শুরু হয় চড়ক পূজার আনুষ্ঠানিকতা। আজ বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টায় চড়ক গাছ দিঘীর পানি থেকে তোলা হয়। প্রায় ১৩ হাত দৈর্ঘ্যের শালগাছটি চড়ক গাছ নামে পরিচিত। মনোবাসনা পূরণের আশায় সেই চড়ক গাছে তেল, দুধ, চিনি, মাখন ঢালেন ভক্ত অনুসারীরা। এছাড়া আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে ছিল ভরন চালান, কালী নাচ, পাঠাবলি, ফুল ভাঙ্গা, হাজরা ছাড়া সহ আনুসঙ্গিক পূজা অর্চনা।
পূজা ও মেলাকে কেন্দ্র করে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ ও উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়েছে। মেলা প্রাঙ্গনে বসেছে নাগরদোলা। নানা ধরণের পসরা সাজিয়ে বসেছেন দোকানীরা।
চড়কমেলা সম্বন্ধে বোঁথর গ্রামের বাসিন্দা এবং এ পূজার প্রধান পুরোহিত সৌরেশ চক্রবর্তী শুটকা ঠাকুর জানান, বান রাজার আমল থেকে অর্থাৎ প্রায় ৭০০ বছর আগে থেকে এখানে চড়কমেলা চলছে। প্রথম চড়কগাছ প্রতিস্থাপন করেছিলেন অমূল্য সান্যাল নামের এক কাঠ ব্যবসায়ী। আসাম থেকে কিনে আনা তার কাঠের মধ্যে চড়কগাছের আগমন ঘটেছিল এখানে। আর অমূল্য সান্যালের স্ত্রীকে স্বপ্নের মাধ্যমে দেবতা মহাদেব জানিয়ে দেন চড়ক হয়ে তিনি এসেছেন এখানে। তাকে স্থাপন করে যেন পূজা দেওয়া হয়। সেই থেকে সান্যাল আর আচার্য্য পরিবার পূজা শুরু করেন হলদার আর সূত্রধরদের নিয়ে।
আচার্য্য পরিবারের বিপ্লব কুমার আচার্য্য জানান, পূজা ও মেলা উপলক্ষ্যে বোঁথর গ্রামে জামাই-মেয়েকে এরই মধ্যে দাওয়াত করে নিয়ে এসেছেন। নতুন জামাই-মেয়েকে এ সময় ইলিশ মাছ খাওয়ানের চল বহুদিনের। জামাই-মেয়ের পাশাপাশি দুরের আত্নীয়-স্বজনরাও বোঁথর গ্রামে বেড়াতে এসেছেন।
তিনি আরও জানান, এবারের ৩ দিনের উৎসবের মধ্যে বৃহস্পতিবার (১৩ এপ্রিল) চড়কগাছ পুকুরের পানি থেকে তোলা হয়। ভক্ত অনুসারীরা তাদের মনবাসনা পূরণের আশায় চড়ক গাছে তেল দুধ-দই-চিনি মাখেন। ভরন চালান দেওয়া, ভরন নাচ, কালীনাচ, পাঠাবলিসহ আনুসঙ্গিক পূজা-অর্চনা হয়েছে। রাতে ফুলভাঙ্গা, হাজরা ছাড়া হচ্ছে। শুক্রবার চৈত্র সংক্রান্তির তিথিতে চড়কগাছ ঘোরানো হবে। শুক্রবারের দিনটাই বেশী জাকজমকপূর্ণ হবে এবং লোক সমাগমও বেশি হবে বলে সংশ্লিষ্টরা আশা করছেন। শনিবার প্রতিমা বিসর্জনের মধ্যদিয়ে ঐতিহ্যবাহী বোঁথরের চড়ক পূজা ও মেলা উৎসব শেষ হবে।
এদিকে চড়ক পূজা প্রথম যে বাড়ি থেকে শুরু হয়, সেই ‘চাঁদবাড়ী’র বড়কর্তা শংকর কুমার সাহা জানান, মেলার জৌলুস আগের চেয়ে কমে গেছে। তিনি বলেন, চড়কবাড়ির মন্দির টিনের আটচালা থেকে এখন পাকা হয়েছে বটে তবে সেই জৌলুস নেই। আগে টানা সাত দিন চলত মেলা। এখন পরিধি কমে ৩ দিনে এসে ঠেকেছে। মেলার লোক সমাগমের গমগম শব্দ আগে ৫ কি.মি দূর থেকেও কানে বাজত। তিনি আরও জানান, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, দিনাজপুর, বগুড়া, ঢাকা এমনকি ভারত থেকে রকমারী পন্যসামগ্রী নিয়ে দোকানদাররা আসত মেলায়। নাগরদোলা, ঘোড়াদোলা, বায়োস্কোপ, যাত্রা, পুতুলনাচ, সার্কাস আসতো। এখন অনেক কিছুই স্মৃতি বলে তিনি জানান।
পূজা উপলক্ষে হাজার হাজার ভক্ত বাতাসা ছিটায় মঙ্গলার্থে। ছাত্র-ছাত্রীরা পূজা দেয় ভালো ফলাফলের আশায়। কেউ মেলায় আসা মানুষকে জলপান করায়। কেউ করে আতিথেয়তা। মাথার চুলের জটা কাটা হয়, উপোস করে কেউ কেউ। আরো কতো কী।