পাবনা

চাটমোহর হানাদার মুক্ত দিবস আজ

  প্রতিনিধি ২০ ডিসেম্বর ২০২২ , ৮:২২:৩৯

২০ ডিসেম্বর চাটমোহর পাক হানাদার মুক্ত দিবস।

১৬ ডিসেম্বর সারাদেশ যখন বিজয়ের উল্লাসে মাতোয়ারা পাবনার চাটমোহর উপজেলা তখনও ছিল অবরুদ্ধ। একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর সারাদেশ হানাদার মুক্ত হলেও চাটমোহর শত্রু মুক্ত হয় তার চারদিন পর (২০ ডিসেম্বর)।

জানা যায়, ১৯৭১ এর এপ্রিলে পাক হানাদার বাহিনী দু’বার পাবনা শহরে ঢোকার চেষ্টা করে। কিন্তু তৎকালীন ডিসি নুরুল কাদের খান এর নেতৃত্বে পুলিশ ও ছাত্র জনতার প্রতিরোধের মুখে পিছু হটে পালিয়ে যায়।

এপ্রিল মাসের শেষ দিকে অত্যাধুনিক অস্ত্র-শস্ত্রে সজ্জিত হয়ে পাক হানাদার বাহিনী ঢাকা থেকে পাবনার নগরবাড়ী ঘাট অতিক্রম করে পাবনায় ঢুকে পড়ে। এ সময় তারা পর্যায়ক্রমে পাবনার চাটমোহরসহ বিভিন্ন অঞ্চল দখল করে নেয়। চাটমোহর উপজেলা সদরের বিভিন্ন এলাকায় আগুন ধরিয়ে দেয় তারা।

শহরের হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের নেতৃস্থায়ীদের শান্তি আলোচনার নাম করে পুলিশ দিয়ে থানায় ডেকে এনে তাদের আটক করে। তৎকালীন ন্যাশনাল ব্যাংক চাটমোহর শাখা লুট করে নেয় পাক হানাদাররা। ব্যাংক ম্যানেজার আবুল কালাম খান ও ক্যাশিয়ার শামসুল ইসলাম সহ দু’জন গার্ডকে এসময় তারা গুলি করে হত্যা করে। তার পরে হত্যা করে বিশিষ্ট ব্যবসায়ী যতীন কুন্ড, রঘুনাথ কুন্ড, ঝরু ঠাকুর ও অশ্বিনী কুন্ডকে।

তৎকালীন চাটমোহর থানার দারোগা (বড় বাবু) তোরাপ আলী মোল্লা ও সেকেন্ড কর্মকর্তা আবুল কাশেমের সাহসিকতায় থানায় আটক ব্যক্তিরা প্রাণে রক্ষা পায়। এ দু’জনকে পুলিশ তালা ভেঙ্গে তাদের পালাতে সাহায্য করে এবং নিজেরাও পালিয়ে যান। পাক হানাদাররা এ সব হত্যা ও তান্ডব চালিয়ে পাবনা চলে যায়।

কয়েক দিন পরে এসে তারা চাটমোহর থানা দখলে নিয়ে স্থায়ীভাবে অবস্থান নেয়। এরপর তারা রাজাকার বাহিনী ও শান্তি কমিটি গঠন করে। শান্তি কমিটি ও রাজাকারদের সহায়তায় সাড়ে সাত মাস অত্যাচার নির্যাতন চালিয়ে চাটমোহর দখলে রাখে। নভেম্বরের প্রথম দিকে মুক্তিযোদ্ধারা গ্রামাঞ্চলে অনুপ্রবেশ করেন। এলাকাবাসীর সহায়তায় থানা আক্রমনের জন্য সংগঠিত হতে থাকে। হানাদারদের উপর ছোট খাটো চোরাগোপ্তা হামলাও চালাতে থাকে। এভাবেই মুক্তিযোদ্ধারা থানা সদরের দিকে এগুতে থাকে। এ খবরে চাটমোহরের হানাদাররা দমে যায়, তারা বাইরে বেরুনো বন্ধ করে দেয়।

মুক্তিযোদ্ধারা ১৩ ডিসেম্বর চাটমোহর থানা আক্রমণ করে। মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মোজাম্মেল হক ময়েজ, এসএম মোজাহারুল হকের নেতৃত্বে ব্যাপক আক্রমনের মুখে হানাদাররা থানায় আটকা পড়ে। শেষ আশ্রয়স্থল হিসেবে থানাটিকে দুর্ভেদ্য দূর্গে পরিণত করে।

ওইদিন হানাদারদের হাতে আটকা পড়ে উপজেলার রামনগর গ্রামের সহযোগী মুক্তিযোদ্ধা দুই সহোদর মোসলেম উদ্দিন ও আবু তালেব। পরদিন সকালে হানাদাররা দুই সহোদরকে গুলি করে হত্যা করে।

১৫ ডিসেম্বর থানা আক্রমণ করে হানাদারদের আত্মসমর্পণে বাধ্য করে। এ সময় মুক্তিযোদ্ধারা শের আফগান নামের এক দুর্ধষ হানাদার সহ বেশ কয়েক জনকে গুলি করে হত্যা করে।

১৬ ডিসেম্বর বিকেলে হানাদার বাহিনী আত্মসমর্পণ করতে সাদা পতাকা উড়িয়ে ফ্লাগ মিটিং এর আহŸান জানায়। এ অবস্থায় দু’দিন গোলাগুলি বন্ধ থাকে।

১৮ ডিসেম্বর সকাল ১১টায় কমান্ডার মোজাম্মেল হক ময়েজ ও এসএম মোজাহারুল হক। বেলা ২টায় তারা ফিরে এসে জানায় পাক হানাদার বাহিনী আত্মসমর্পনে রাজি হয়েছে। তারা মিত্র বাহিনীর উপস্থিতিতে আত্মসমর্পনের শর্ত দিয়েছে।

অবশেষে ২০ ডিসেম্বর সকালে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার পাবনায় গিয়ে জেলা কমান্ডার রফিকুল ইসলাম বকুলকে মিত্র বাহিনীর পোষাক পড়িয়ে চাটমোহরে নিয়ে আসেন। ওইদিন বেলা ২টায় নকল মিত্র বাহিনীর কমান্ডার রফিকুল ইসলাম বকুলের কাছে হানাদাররা আত্মসমর্পণ করে এবং তাদেরকে ঘোড়ার গাড়িতে করে পাবনা পাঠিয়ে দেয়া হয়। এ ভাবেই বিজয় দিবসের চারদিন পর ২০ ডিসেম্বর চাটমোহর হানাদার মুক্ত হয়। তখন থেকেই এই দিনটি ‘চাটমোহর হানাদার মুক্ত দিবস’ হিসেবে পালিত হচ্ছে।